অবশেষে মৃত্যুদণ্ড, প্রধান সাক্ষী থেকে আসামি, (মিন্নি) রিফাত হত্যাকাণ্ড (বাংলা আমার প্রাণে)
এই নির্মম ঘটনার পরের দিন নিহত রিফাতের বাবা দুলাল শরীফের দায়ের করা মামলায় মিন্নি ছিলেন একমাত্র প্রত্যক্ষ সাক্ষী। যাকে ঘটনার সময় ঘাতকদের ধারালো অস্ত্র উপেক্ষা করে তার স্বামী রিফাতকে রক্ষা করতে দেখা যায়। পরে সেই মিন্নি আসামি হলেন এবং মামলার রায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হলেন।
এটি একটি মধ্যযুগীয় কায়দায় হত্যাকাণ্ড, এ রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, যা দেশ বিদেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে। রিফাতের উপর হামলার সময় তার স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি রিফাতকে বাঁচানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেছেন। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে মিন্নির সম্পৃক্ততা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যুবসমাজ, দেশের সব বয়সের মানুষ তাদের নির্মমতা প্রত্যক্ষ করেছেন। এমতাবস্থায় তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হলে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে দেশের যুবসমাজ ভুল পথে অগ্রসর হওয়ার আশঙ্কা থাকবে। তাই আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া বাঞ্ছনীয়।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, আদালত এ মামলার রায়ে মিন্নির বিরুদ্ধে হত্যার ‘মূল ষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবে ঘাতকদের সাথে পরিকল্পনা করা ও হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ এনেছে। মামলার পর্যবেক্ষণে আদালত রিফাত শরীফ হত্যার ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে পরিকল্পনা মোতাবেক রিফাত শরীফ কলেজ থেকে বের হয়ে বাইকে ওঠার সময় কলার ধরে টেনে নামিয়ে কালক্ষেপণ ও ঘাতকদের আক্রমনের সময় মিন্নির স্বাভাবিক আচরণকে বিবেচনায় নিয়েছে। এছাড়াও হত্যার পরে ঘাতকদের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ ও ক্ষুদে বার্তা পাঠানো, একাধিক ঘাতকের সাথে যোগাযোগের বিষয়টি আমলে নিয়েছে। আর এর কারণ হিসেবে নয়ন বন্ডের সাথে বিয়ে গোপন করে রিফাত শরীফের সাথে বিয়ে এবং এ নিয়ে উভয়ের স্নায়ুযুদ্ধ সৃষ্টি হওয়া, এক পর্যায়ে হামলা ও হত্যার ঘটনা পর্যন্ত গড়িয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। মূলত- রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ মিন্নি এবং পরে মিন্নিকে ঘিরে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে বন্ড বাহিনী রিফাতকে হত্যা করেছে। আর সেই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মিন্নি নিজেই প্রত্যক্ষ মদদ জুগিয়ে ঘাতকদের সাথে ষড়যন্ত্র করেছে বলে আদালতের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।
গত বছরের ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে রিফাত শরীফকে দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে বরগুনার কিশোর গ্যাং বন্ড বাহিনী। পরে ওইদিন বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন রিফাত। ঘটনার পরের দিন বরগুনা সদর থানায় ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৫-৬ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহত রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। এতে স্ত্রী মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করা হয়। এদিকে রিফাত শরীফের উপর হামলার একটি ভিডিও ভাইরাল হলে মিন্নির প্রতি সহমর্মিতা জেগে ওঠে। পাশাপাশি হামলাকারী নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজীর হাত থেকে রিফাত শরীফকে বাঁচাতে মিন্নির আপ্রাণ প্রচেষ্টার জন্য দেশব্যাপী সাহসীকন্যা খ্যাতিপান মিন্নি। স্বামীকে বাঁচাতে মিন্নির প্রচেষ্টার জন্য বাহবা পায় সর্বত্র। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের দুদিন পর গণমাধ্যমে মিন্নি ও নয়ন বন্ডের বিয়ের খবর প্রকাশিত হয়। একই সঙ্গে প্রকাশিত হয় হত্যাকাণ্ডের আগের দিনও নয়ন বন্ডের বাসায় মিন্নির যাওয়ার খবর। এতে মুহূর্তেই মিন্নির অবস্থান উল্টে যায়। এরপর থেকেই মিন্নির ওপর সন্দেহের চোখ যায় পুলিশের। আর তখন থেকেই মিন্নির বাড়িতে মোতায়েন করা হয় পুলিশ সদস্যদের।
রিফাত হত্যাকাণ্ডের ১৭দিন পর গত বছরের ১৩ জুলাই বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মিন্নিকে এ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড উল্লেখ করে তাকে গ্রেপ্তারের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেন এ মামলার বাদি ও নিহত রিফাত শরীফের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। এরপর ওইদিন রাতেই পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে সংবাদ সম্মেলন করেন মিন্নি। এর পরের দিন ১৪ জুলাই বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন মিন্নির বাবা মো. মোজ্জাম্মেল হোসেন কিশোর। তিনিও রিফাত হত্যাকাণ্ডের মিন্নির জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
দুই পরিবারের পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলনের পরের দিন গত বছরের ১৫ জুলাই বরগুনার সরকারি কলেজের সামনে থাকা একটি সিসি ক্যামেররার ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ পায়। এতে দেখা যায়, হামলার আগ মুহূর্তে রিফাত শরীফ ঘটনাস্থল ত্যাগ করতে চাইলেও গড়িমসি করে সময় ক্ষেপণ করেন মিন্নি। এরপর দলবদ্ধভাবে বন্ড বাহিনী রিফাত শরীফকে মারতে মারতে কলেজ গেট থেকে সামনের দিকে নিয়ে গেলেও তখন মিন্নি স্বাভাবিকভাবে হাঁটছিলেন হামলাকারীদের সাথে।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজে আরো দেখা যায়, রিফাত ফরাজির নেতৃত্বে যখন রিফাত শরীফকে কিলঘুষি মারা হচ্ছে তখন নয়ন বন্ড দৌড়ে এসে হামলা করে রিফাত ফরাজীর উপর। এসময়ও রিফাতকে বাঁচাতে কোন ভূমিকাই রাখেননি মিন্নি। এরপর রিফাত ফরাজি দৌড়ে গিয়ে দুটি দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে এসে একটি দিয়ে নিজে কোপাতে থাকেন রিফাত শরীফকে আর অন্যটি দিয়ে রিফাত শরীফকে কোপাতে শুরু করেন নয়ন বন্ড। এ সময় মিন্নি রিফাততে বাঁচাতে আপ্রাণ প্রচেষ্টা করেন। রিফাতের উপর হামলা শেষে বন্ড বাহিনী চলে গেলে রিফাতকে নিয়ে হাপাতালেও যান মিন্নি।
এদিকে রিফাতের মৃত্যুর ১৯ দিন পর গত বছরের ১৬ জুলাই সকালে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিন্নিকে বরগুনার পুলিশ লাইনে নিয়ে আসে পুলিশ। এরপর ওইদিন রাতেই এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে মিন্নিকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় পুলিশ। পরের দিন ১৭ জুলাই বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে মিন্নির সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। পরে আদালত মিন্নির পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পাঁচ দিনের রিমান্ডের তৃতীয় দিনেই বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে স্বামীর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা শিকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন মিন্নি। এরপর থেকে টানা ৪৯ দিন কারাভোগের পর গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হন মিন্নি। আর মিন্নির কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার দুদিন আগে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বিকালে মিন্নিকে প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের মধ্যে ৭ নম্বর অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। চার্জশিটে মিন্নিকে এ হত্যার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অ্যাড. মুজিবুল হক কিসলু বলেন, মিন্নি প্রথমে এ মামলার সাক্ষী ছিলেন এটা সত্য। কারণ যখন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সেখানে নিহত রিফাতের বাবা উপস্থিত ছিলেন না। সেখানে উপস্থিত ছিলেন পুত্রবধূ আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি। তখন সরল মনে রিফাত শরীফের বাবা আ. হালিম দুলাল শরীফ পুত্রবধূ মিন্নিকে এ মামলার এক নম্বর সাক্ষী রাখেন। পরে যখন তিনি বুঝতে পারেন যে মিন্নির সাথে হত্যাকারী নয়ন বন্ডের বিয়ে এবং সখ্য ছিলো, যখন তিনি এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে মিন্নির পূর্বপরিকল্পনার বিষয়টি বুঝতে পারেন তখনই তিনি সংবাদ সম্মেলন করে মিন্নিকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান।
অ্যাড. মুজিবুল হক কিসলু আরও বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের আগে এবং পরে নয়ন বন্ডসহ হত্যাকারীদের সঙ্গে মিন্নির একাধিক যোগাযোগ হওয়ার বিষয়টি আদালতের কাছে প্রমাণিত হযেছে। তাছাড়া রিফাত শরীফের আগে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির বিয়ের কাবিনসহ সংশ্লিষ্ট কাজিও আদালতে সাক্ষী দিয়েছেন। এসব কিছুর পর্যাপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণে আদালতের কাছে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে, রিফাত হত্যা মামলার মাস্টারমাইন্ড মিন্নি। ফলে আদালত মিন্নির বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনের দণ্ডবিধি প্রয়োগ করেছেন।
কোন মন্তব্য নেই